নিজের জন্মদিন পালন নিয়ে কখনো তেমন কোন আগ্রহ বা উচ্ছাস ছিলনা তার। ছোটবেলা থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত অনেক জন্মদিন কেটেছে নিজেরই অজান্তে। আশি ও নব্বই দশকে সমাজের সর্বস্তরে জন্মদিনে উইশ করার প্রচলন তেমন একটা ছিল না। তারপরও মাঝে মধ্যে কেউ উইশ করলে, তখন ভাললাগার পাশাপাশি খানিকটা সুখময় লজ্জা পেতো। তবে আশপাশের পরিচিত এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্মদিনের আয়োজন বেশ উপভোগ করতো। খাওয়া-ধাওয়া মধ্যে বিশেষ করে সুস্বাধু কেক হলে, কয়েক পিস ছাড়া চলতোইনা। তবে চকলেট কেক তার প্রিয় ।
সময়ের মাঝে জীবনের পালাবদলের সাথে-সাথে এখন তিন-তিনটি জন্মদিন তার জীবনের তিনটি উৎসবে পরিনিত হয়েছে। তার মধ্যে দু’ছেলের জন্মদিন ঘটা করে না হলেও আনন্দঘন পরিবেশে সব সময়ই পালিত হয়।
বিশ শতকের শুরু। তখন ছিল বিজয়ের মাস, বিজয় উৎযাপনের একদিন পর ১৮ ডিসেম্বর দুপুর বারোটা দশ । বড় ছেলের জন্মের সময়টা, এতো বছর পরও, এখনো তার স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে ভেসে উঠে।
খুবই ছোট তিন দশমিক দুই কেজি ওজনের একটা নবযাতক শিশুকে তোয়ালের ভেতর পটলার মত করে নার্স তার হাতে তুলে দিয়েছিল। সে কখনো কোন নবজাতক শিশুকে পৃথিবীতে আসার পর-পর এইভাবে কোলে তুলে নেয়নি।
বুকের মাঝে আগলে রেখে শিশুটির মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হাসপাতালের কেবিনে সে একা। বউ ওটি রুমে যন্ত্রনায় কাতর। শিশুটির চোখ বন্ধ, হাত-পা, ঠোঁট,নাক,কান খুবই ছোট । নবযাতক শিশুরা এতো ছোট হয়?শিশুর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে সে শুধু বিস্ময়কর ভাবে তাকিয়েছিল।
হঠাৎ শিশুটির হাত-পা নাড়ানোর সাথে-সাথে তার মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শিশুটির চোখের পাতা নড়াচড়ার সময় ওর চোখ দুটো খুঁজতে থাকে সে। শিশুটি বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে অনেক কষ্টে একটু করে চোখ খুললে নবযাতকের চোখের ভেতর হঠাৎ নিজেকেই খুঁজতে থাকে সে।
নিজের ভেতর তখন বেশ গর্বের সাথে উচ্চারিত হতে থাকে,‘এইটি আমার সন্তান ’?
মনের ভেতর থেকে পাল্টা প্রশ্ন.‘তোমার হল কি ভাবে?
ভেতর থেকে জবাব আসে,‘ওর সারা শরীরে আমার রক্ত’?
পাল্টা জবাব,‘ওতো, ওর মায়ের কাছ থেকে এসেছে’, তোমার রক্ত হলো কিভাবে ?।
মনের ভেতর জবাব এবং পাল্টা জবাবের কারণে আবেগের কাছে যুক্তিগুলো বারবার পরাজিত হচ্ছে।
তারপরও সে তখন শুধু মনের মাঝে ভাবতে থাকে, শিশুটিই শুধু আমারই ছেলে, আমি ওরই সব। শিশুটি আমাকে এই পৃথিবীতে বাবা হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছে। ওর মাঝে সারাজীবন আমি, শুধু নিজেকে খুঁজতে থাকবো। ওর শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ, শ্বাস-প্রশ্বাসে সব কিছুর মধ্যে রয়েছে আমার অস্তিত্ব।
গর্বের সাথে প্রশান্তিময় বাবা হওয়ার অনুভুতি ক্ষণিকের জন্য তাকে আছন্ন করে ফেলে। দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের সমন্বয় একটা নতুন আবস্থান তার ভেতর সৃষ্টি হতে থাকে। বাবা হওয়ার আনন্দে সে স্বার্থপরের মত অলিক কল্পনার জগতে ডুব দিয়েছিল।
নবযাতক শিশুটি যে বাবা-মা দুজনের সন্তান এই বোধটা সে সময় উত্তেজনার কারণে লোপ পেয়েছিল। শিশুটির কচি কন্ঠে কান্নার শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে সে।
দীর্ঘ ১১ বছর পর, একই মাসে তথা বিজয় উৎযাপনের প্রস্তুতির সপ্তাহ খানিক আগে ৯ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় তার ছোট ছেলের জন্ম । সেদিনও আবার বাবা হওয়ার উত্তেজনা তাকে আছন্ন করে ফেলেছিল। তবে সেই দিন জন্মেও পর-পর নবযাতক শিশুটি তার হাত দিয়ে নিজে-নিজে ওর মুখে খামছি দিয়ে মুখটা লাল করে ফেলেছিল। তখন বাধ্য হয়ে শিশুটির ছোট হাতের তুলতুলে আগুলের প্রায় অদৃশ্যহীন নোখ কাটতে গিয়ে একটু রক্ত বের হয়েছিল। সেই কষ্ট আজও সে ভুলতে পারেনি। দুই ছেলের জন্মদিন তাই তার কাছে বিশেষ মর্যদা বহন করে। বছরের এই দুই দিন সব সময়ই তার জীবনের আনন্দময় স্বরণীয় দিন হিসেবে উদযাপিত হয়।
তৃতীয় জন্মদিন হলো হল “শংখিনী”র জন্মদিন।
পারিবারিক ভাবে আয়োজিত বিয়েতে অচেনা বর-কনের মধ্যে যখন ভালোলাগার সহ ভালোবাসার তীব্র আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। তখন যে কারো জন্মদিন মানেই তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় উৎসবে পরিনিত হয়।
বিয়ের এক মাসের মধ্যেই পড়েছিল শংখিনীর প্রথম জন্মদিন। খোলা আকাশের নিচে ছাতার অববয়ে এক রেঁস্তরায় বসেছিল তারা । মহাপ্রলয়ংকরের প্রলয়ের সব উচ্ছাস সেদিন ছিল শংখিনীর চোখে-মুখে। নব্য শাড়ী পরা বউ-বউ টাইপের কিশোরী মেয়েটির চোখ-মুখ সহ পুরো শরীরে বইছে আনন্দের জোয়ার। জন্মদিনে কেউ এতো খুশী হতে পারে? সেইদিনই ওকে দেখে, প্রথম উপলদ্ধি । শংখিনী জানালে,‘ আজকের জন্মদিনে, এতো ভাললাগার মত পরিবেশ এর আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি’।
চট্টগ্রামের খুলশীর ‘তাবা’ নামক রেঁস্তরাটি ছিল তখন খোলা জায়গায়। ক্রংক্রিটের বেশ কয়েটি ছাতা খানিটা দুরত্বে ছিটিয়ে রেখেছে। ছাতার ভেতর বসার জায়গা সহ খাওয়ার টেবিল। সন্ধার পর-পর আলো-আধারের হালকা মিশ্রনে স্বপ্নের ছায়ার মত চমৎকার জায়গাটিতে বসলে গানের পিপাসা জাগ্রত হয়। সংগীতশিল্পী কন্ঠে নিজ থেকে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি জনপ্রিয় গানের আংশিক গেয়ে পুরো পরিবেশে নতুন মাত্রা যোগ করলো শংখিনী। বিশেষ করে দুর আকাশে হেলে পরা চাঁদের দিকে থাকিয়ে,
‘চাঁদের হাসি বাধঁ ভেঙ্গেছে—–, গানটির সাথে তখন সময়-প্রকৃতি, অন্ধকারের সৌন্দর্য, ভালোবাসার শীতল বাতাস সহ সব কিছুই ক্ষনিকের জন্য স্তব্ধ করে নতুন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করে, সবকিছু একাকার করে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের এই জনপ্রিয় গানটি অনেক দামী গলায় অনেকবার শুনেছে, কিন্তু সেই সময় মনে হয়েছে, কবিগুরু আজকের নির্দিষ্ট এই সময়ে জন্যই গানটি সেদিন রচনা করেছিলেন । গানের প্রতিটি শব্দ-সুর, আবেগ সেই সাথে ওর মমতা মাখানো কন্ঠে নেশায় শুধু আছন্ন হয়ে পড়েছিল। তার সাথে শংখিনীর প্রথম জন্মদিন পালনের কথা ২৩ বছর পরও এখনো জীবন্ত সুখময় অনুভূতি ধারণ করে শুধু আলো ছড়িয়েই চলছে।
অনেক কিছুই সে খুব সহজেই ভুলে যায়। তাই, ভোলা মনের মানুষ হিসাবে তার পরিচিত রয়েছে। সময়মত মনে থাকে না অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য। তবে সে কখনো ভোলেনা শংখিনীর জন্মদিনের কথা ।
প্রেম-ভালোবাসা, কষ্ট-বিরহ, সুখ-আনন্দসহ সংসারের টক-ঝাল-মিষ্টির মিশ্রনের তিল-তিল করে গড়ে ওঠা ভালবাসার আনন্দ সবাইকে কাঁদায়। আনন্দময় কান্নার প্রতিটি ফোঁটা সবার কাছেই অমূল্য সম্পদ। কারণ এইসব চাইলেই সহজে ধরা দেয় না। ধরা দেয় আত্ম উপলব্ধির মাধ্যমে সাধনা করলে। ম্যানি-ম্যানি রিটার্ন অব দা ডে—। শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা তোমায়—-।