“দৈনিক দিনকালে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে লেখা যাবে। যদি কেউ অন্যায় করে, দলীয় শৃঙ্খলা কিংবা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় তবে অবশ্যই নিউজ করা যাবে। তবে তথ্য প্রমাণ থাকতে হবে”।এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে সবার দিকে তাকালেন তারেক রহমান। তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সম্প্রতি তিনি দৈনিক দিনকালের দায়িত্ব নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করছিলেন । ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে জনাব তারেক রহমান দৈনিক দিনকালের সাথে যুক্ত হন।
উপস্থিত সাংবাদিকরা তখন একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছেন। যেন তারেক রহমান অবাস্তব কিছু বলছেন। দীর্ঘদিন থেকে দৈনিক দিনকাল জাতীয়তাবাদী প্রকাশনী লিমিটেড তথা বিএনপির পত্রিকা হিসাবে পরিচিত। সেখানে-বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কিভাবে লিখবে? তাছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই বিএনপি থেকে বড় বিএনপি মানসিকতা লালন করার কারণে মনে মনে কথাগুলো উড়িয়ে দিলেন। তবে ভাবখানা এমন করে রাখলেন যেন তারেক রহমানের কথাগুলো শুধু গিলছে। সবাই চুপচাপ। মন দিয়ে শুধুই শুনছেন।
তারেক রহমানও বিষয়টি বুঝতে পেরে আবার বললেন,” আমি দৈনিক দিনকালকে গণমানুষের পত্রিকা হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। বিএনপির মুখপাত্র বা লিফলেট করতে চাই না। সম্পাদকীয় কিংবা উপ-সম্পাদকীয় পাতায় দলীয় আদর্শের কথা থাকতে পারে কিন্তু রিপোর্টিং হবে নিরপেক্ষ “।
তারেক রহমান সাধারণত কম কথা বলেন। তবে শুনেন বেশি। ঢাকার তেজগাঁর দিনকাল অফিসে বিভিন্ন ব্যুরো প্রধান ও জেলা প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ কালে সাংবাদিকদের বিভিন্ন অভাব, অভিযোগ ও সমস্যার কথা অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কিছু অংশ নিজেই নোট করে তারেক রহমান সমাপনী বক্তব্য তার মনের কথাগুলো সবার মাঝে প্রতিধ্বনি করলেন।
উল্লেখ্য দীর্ঘকাল ধরে দৈনিক দিনকাল শুধুমাত্র বিএনপির পত্রিকা হিসেবে পাঠকমহলে পরিচিত হয়ে আসছে। বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের প্রেস রিলিজ ও নেতাকর্মীদের বিশাল নামের তালিকা ছাপাতে গিয়ে পত্রিকাটি বিএনপি’র লিফলেটে পরিনিত হয়ে পড়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের নিউজ ছাপাতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকলেও বিএনপির লোকজন নিজেরাও পত্রিকাটি পড়ে না। যদি পড়তো তাহলে দৈনিক দিনকালের সার্কুলেশন থাকতো সবার উপরে।
মজার ব্যাপার হলো, নেতারা নিউজ ছাপাতে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠতো যে তাদের নিউজ ছাপাতে সম্পাদককে পর্যন্ত ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে ছাড়তো না। তাদের ধারণা দিনকালে তাদের নিউজ সহ নাম ছাপা হলে দলীয়ভাবে তাদের হাজিরা পূর্ণ হবে। দীর্ঘকাল এভাবে চলতে থাকার কারণে দিনকালের সাংবাদিক সহ অনেকেই নিজ দায়িত্বে বিএনপির দলীয় মানসিকতা লালন করতে শুরু করেন।
অথচ তারেক রহমান দৈনিক দিনকালের দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন আঙ্গিকে পত্রিকাটিকে সাজানোর স্বপ্ন দেখেন। তখন তিনি বাসা ও দৈনিক দিনকালের অফিস ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। দিনকালের তেজগাঁও অফিস সাজানোর ছোটখাটো সব কিছু তিনি নিজেই দেখভাল করতেন। তিনিই প্রথম সারাদেশে দিনকালের বিভাগ, জেলা ও উপজেলার কয়েক’শ সংবাদদাতাদের নিয়ে ঢাকায় প্রতিনিধি সভা করেন। সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলা মত বিনিময়ের মাধ্যমে দিনকালকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা লালন করতে থাকেন। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জেলার দিনকালের সার্কুলেশনের উন্নয়নের জন্য পত্রিকার এজেন্ট সহ হকদারদের সাথেও তিনি মতবিনিময় করেন। সব আলোচনায় তারেক রহমান দৈনিক দিনকালকে গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস চালান।
তখন দৈনিক দিনকালকে নিয়ে তারেক রহমান এতটাই বিভোর ছিলেন যে, সারাদিন দিনকাল অফিসে কাটানোর পর পত্রিকা ছাপার আগ পর্যন্ত ছাপাখানায় অপেক্ষায় থাকতেন। পরদিনের ছাপানো অগ্রীম পত্রিকা নিয়েই তিনি গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন।
তরুণ তারেক রহমান দৈনিক দিনকালকে নিয়ে এতটাই আবেগ তাড়িত ছিলেন যে, তিনি দিনকালকে তার সন্তানের সাথে তুলনা করতেন।তিনি প্রায় বলতেন, তার মেয়ে জায়মা ও দিনকাল তার ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ জায়গা দখল করে আছে। মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তার সারাক্ষণের ভাবনায় ছিল শুধুই দিনকাল।
অথচ তার আশেপাশের দুই চারজন ছাড়া কেউই তার অন্তরে ভাবনা ঠিক বুঝতে পারেনি। তবুও দৈনিক দিনকাল ধীরে ধীরে বদলে যাওয়ার চেষ্টা করে। দলীয় প্রেস রিলিজ ছাপার সংখ্যা কমতে থাকে, স্পট নিউজে নিরপেক্ষতা আসলেও পাঠকদের কাছে সেই বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি।
১৯৯৯ সালে বিএনপি ছিল সংসদ ও রাজপথে প্রধান বিরোধী দল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় বিভিন্ন দাবিতে অবরোধ সহ হরতালের মত কর্মসূচীর মাধ্যমে রাজপথে সক্রিয় ছিল বিএনপি।হরতালের মত কর্মসূচিতে কর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও নেতাদের বিশেষ করে এমপি সহ শীর্ষ নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল তুলনামূলক কম। বিষয়টি তারেক রহমানের দৃষ্টিগোচর হলেও তিনি দৈনিক দিনকালের সম্পাদক সহ নিউজ এডিটরকে পরামর্শ দিলেন, হরতালের দিন সারা দেশের বিএনপির নেতারা কে কোথায় আবস্থান করছে তাঁর তালিকা নিয়ে নিউজ করতে। যারা মাঠে অনুপস্থিত থাকবে তারা কোথায়? তাও নিউজে উল্লেখ করতে বলা হল। পরদিন দৈনিক দিনকালের প্রথম পাতায় ছাপা হল “হরতালে বিএনপি নেতারা কে কোথায়”?
সেদিনই প্রথম দৈনিক দিনকালকে নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। পাঠকরা প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, দিনকাল তার দলীয় খোলস থেকে বেরিয়ে গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে সূচনা করেছে পথ চলার ।###
লেখক: মাহবুব রশীদ । সাবেক ব্যুরো প্রধান, দৈনিক দিনকাল, চট্টগ্রাম অফিস।