মালির রাজধানী বামাকোর সংরক্ষিত এলাকায় ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী জঙ্গিদের প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়া বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্যরা সাত ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর অবশেষে ক্যাম্পে ফিরেছে। তবে আবারও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে সবাই দেশে ফিরতে চায়।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা তথা মালির ভোর ৬টা মিনুসমার জাতিসংঘ ক্যাম্পের পাশে দুই পক্ষের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪০ জন সদস্য।
২ ঘণ্টার ব্যবধানে এই লড়াই বাংলাদেশ ক্যাম্পের মধ্যে এসে পড়ে। তখন ক্যাম্পে মটার হামলা হয়। সেখানে পুলিশ কনস্টেবল মাহমুদুল হকের হাতে এবং থাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। জরুরী ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। তবে তার প্রকৃত অবস্থা এখনো জানা যায়নি। এছাড়া বেশ কয়েকজন আহত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খুব ভোরে আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন (জেএনআইএম) জঙ্গিরা অতর্কিতভাবে সামরিক এলিট ফোর্স খ্যাত জেন্ডারমেরি ট্রেনিং স্কুল হামলা চালায়।এরপর জঙ্গিরা স্কুলের পার্শ্ববর্তী বিমানবন্দরেও হামলার পরিধি বিস্তৃত করে। তখন বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর দু’ঘণ্টা পর জঙ্গিরা বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন মিনুসমার পাশে মালিয়ান সামরিক বাহিনীর বেস ক্যাম্পে হামলা চালায়। এখানে প্রচুর অস্ত্র মজুত থাকায় তা দখলের জন্য জঙ্গিরা মরিয়া হয়ে উঠে।
মিনুসমার ক্যাম্পের সীমানার বাইরে দায়িত্ব পালনরত মালিয়ান সেনাবাহিনী জঙ্গিদের প্রতিরোধে ফায়ার করলে জঙ্গিরা মিনুসমার ভেতর বাংলাদেশী ক্যাম্পে হামলা করে। এই সময় ক্যাম্পের সাতটি ওয়াচ টায়ারের দুটি মটার হামলায় আক্রান্ত হয়। তখন সেনাবাহিনী ক্যাম্পের ভেতরের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে জঙ্গিদের প্রতিহত করতে এগিয়ে গেলে শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্য প্রচন্ড যুদ্ধ। যুদ্ধে দুই পক্ষ ভারী ও আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। সে সময় নিরস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকে।
মিনুসমা ক্যাম্পে কোনো বাংকার না থাকায় জীবন বাঁচানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে। এক কাপড়েই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসা পুলিশ সদস্যরা খুঁজতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়। এই সময় জাতিসংঘ অফিসের কাউকে দেখা যায়নি। দীর্ঘ সাত ঘন্টা পর দুই পক্ষের গোলাগুলি থেমে এলে বাংলাদেশী পুলিশ সদস্যরা তাদের ক্যাম্পে ফিরে আসে।
১৪০ সদস্যের বাংলাদেশ পুলিশের এই রোটেশন গত ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শান্তি রক্ষা মিশনের দায়িত্ব পালন করে। মালির মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হওয়ার পরও মিনুসমার হেডকোয়ার্টার দেখ ভালের জন্য পুলিশের এই রোটেশনের এক্সটেনশন হলে তাদের গার্ড ইউনিটের দায়িত্ব দেয় হয় । তাই বাংলাদেশ পুলিশের এই সদস্যদের কাছে কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র নেই। অনেকটা নিরস্ত্রভাবে তারা মিনুসমা হেডকোয়ার্টারের ভেতরে দায়িত্ব পালন করে আসছে। বাইরের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে মালিয়ান সেনাবাহিনী। তবে মঙ্গলবারের মত যদি আবারো জঙ্গি হামলা হয় তখন আত্মরক্ষা জন্য কিছু অবশিষ্ট নেই এই পুলিশ সদস্যদের কাছে। রাজধানীর উপকণ্ঠের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায় মঙ্গলবারের মতো আবারও জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানায়।মূলত সেনাবাহিনীর কাছ থেকে দেশের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই জঙ্গিদের কাছে চলে যাচ্ছে।
আবারো জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা বর্তমানে দেশে ফিরতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিষয়টি তারা ঢাকার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে জাতিসংঘ সদর দফতরকে অবহিত করেছে।
এদিকে রয়টার্স জানায়, মঙ্গলবারের রাজধানীর বামাকোতে সংগঠিত জঙ্গি হামলা প্রতিহত করা হয়েছে বলে মালিয়ান সেনাবাহিনী দাবি করেছে। অন্যদিকে আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, “আজ ভোরে, একদল সন্ত্রাসী ফালাদি জেন্ডারমেরি স্কুলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। বর্তমানে মোপিং-আপ অপারেশন চলছে।”
সেনাপ্রধান জেনারেল ওমর দিরারা পরে স্কুল পরিদর্শন করেন এবং সাংবাদিকদের বলেন, “জটিল আক্রমণ” এখন নিয়ন্ত্রণে । অনুপ্রবেশকারী যোদ্ধাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মালিয়ান পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দর ও এর কাছাকাছি একটি সামরিক ঘাঁটির চারপাশে গুলির শব্দ শোনা গেছে। নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, প্রধান বিমানবন্দরের কাছাকাছি এলাকা সহ বেশ কয়েকটি আশেপাশে গুলির শব্দ শোনা গেছে।
২০২৩ সালের ৩০ জুন মালির শান্তিরক্ষী মিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মিশনের সদস্যদের প্রস্তানের জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রায় ১৩ হাজার শান্তিরক্ষী সৈন্যদের সবাইকে ইতিমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিনুসমার হেডকোয়ার্টারের ভেতরের নিরাপত্তার ও মিশনের অবশিষ্ট মালামাল কন্টেইনার করে প্রস্তানের কারণে শুধুমাত্র বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যরা গার্ড ইউনিট হিসেব ক্যাম্পের ভেতর দায়িত্ব পালন করছে। আগামী নভেম্বরে তাদের দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে।
উল্লেখ, ২০১৩ সালে মালিতে জাতিসংঘ মিশন শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩০৩ জনেরও বেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছে। তাই এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।##