দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারের আমলে অনেক বেশি লাভবান হতে পারে। যেমনি লাভবান হয়েছিল নব্বই এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এরশাদের জাতীয় পার্টি।
গত ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ৭৫ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন সবচেয়ে বেশি কঠিন অবস্থা পার করছে। দলের শীর্ষসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গুম, খুনসহ বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। গণরোষের কারণে গত দুই মাসেও দলীয় নেতাকর্মীরা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নোবল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের সমর্থন পেল দেশের অভ্যন্তরে তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কৃত্রিম সংখ্যালঘু সংকট, আনসার বিদ্রোহ, পাহাড়ে অশান্তি সহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলেছে। ইদানিং প্রতি রাতে গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে এই সরকারের বিরুদ্ধে কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতি বিপ্লবের হুংকার দিচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তার দোসরকে দায়ী করা হচ্ছে।
যদি কোন কারণে প্রফেসর ইউনূস বিরক্ত হয়ে দেশ চালাতে আর আগ্রহী না হয় তবে সে দায়িত্বে বিকল্প শক্তি হিসেবে অর্পিত হবে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উপর। যারা আওয়ামী ফ্যাসিজমের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে সোচ্চার অথচ ইউনূস সরকার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে ।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, “সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেদিন তার সাথে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের অনুরোধ করেন”। তখন রাজনৈতিক দলগুলো সেনাপ্রধানকে বলেন,”আপনার নিয়ন্ত্রণে হাজার হাজার সেনার হাতে লক্ষ লক্ষ অস্ত্র, আপনার চেয়ে এখন শক্তিশালী কেউ এদেশে আছে? প্রত্যুত্তরে সেনাপ্রধান বলেন,”সারা দেশের রাজপথের ছাত্র-জনতার শক্তিশালী হাত গুলো কোটি কোটি অস্ত্রের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী”।
সুতরাং সরকারকে বিব্রত করে, বিছিন্ন করার যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন এই মুহূর্তে ছাত্র-জনতাকে উপেক্ষা করে কোন অবস্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে আর ক্ষমতা যাওয়া সম্ভব নয়।
যদি ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী কালীন সরকার আগামী এক/দু বছর মধ্যে সংস্কার কার্যক্রমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে আওয়ামীলীগ দল হিসেবে বিরূপ পরিস্থিতিতেও লাভবান হবে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও পুলিশ সহ বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার পর আগামী জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানো সুযোগ পাবে। যেমন ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় পার্টি সুযোগ পেয়েছিল।
১৯৯০ সালের তীব্র গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন হয়। স্বৈরাচারী এরশাদ পালিয়ে না গেলেও তখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনে আগ পর্যন্ত জাতীয় পাটি ছিল অনেকটা আত্মগোপনে । ১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ের সরকারের সময় নিরপেক্ষ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পায় এরশাদের জাতীয় পার্টি। শত প্রতিকূলতার মাঝেও পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রায় ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৫ টি আসনে জয় লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা উত্তর গত ৫৩ বছরে মধ্যে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে ৪টি নির্বাচনকে তুলনামূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে দেখা হয়। এই চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের দুইবার ক্ষমতায় আসে। এবং এই চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গড়ে ৩৯ শতাংশ ভোট পায়। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচনে সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন জয়লাভ করায় দলে মধ্য প্রথম ফ্যাসিজমের ধারণ লাভ করে।
২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি সরাসরি ফ্যাসিজমের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তায় যুক্ত হয়। ২০১৮ সালে এসে রাতের ভোটের মাধ্যমে সেই ফ্যাসিজম দলে মধ্যে বেড়ে উঠে এবং ২০২৪ সালে এসে ভোটার ছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগে ফ্যাসিজম পূর্ণতা পায়।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা দলটি পাঁচ বছর পর মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামে পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বকারী দল ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল গঠনের পর আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। একই বছরের ১৫ই আগস্টের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আবার আওয়ামী লীগের পুনঃ জন্ম হয়। তাই বর্তমান দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা, ঘুম, খুন ও অর্থপাচার মত গুরুত্ব অভিযোগ মোকাবেলা করে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের পক্ষে ইউনূস সরকারের দেয়া নিরপেক্ষ নির্বাচনে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে নেতাকর্মীরা মনে করে।
তাই নোবেল বিজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের বিপেক্ষ অবস্থান নেয়া উচিত আওয়ামী লীগের। পাশাপাশি নিজের দলের স্বার্থে এই সরকারের সকল সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগিতা করা উচিত ঐতিহ্যবাহী দলটির । ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী নিরপেক্ষ নির্বাচনের যেভাবে জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তেমনি ইউনূস সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে আগামীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে নেতাকর্মীরা মনে করেন।##