শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদটায়ার উৎপাদনঝড় চলছে বাস-ট্রাকের টায়ারের বাজারে ।। এমআরএফের বিকল্প বাজার ব্যবস্থায় আর্থিক ক্ষতির...

ঝড় চলছে বাস-ট্রাকের টায়ারের বাজারে ।। এমআরএফের বিকল্প বাজার ব্যবস্থায় আর্থিক ক্ষতির মুখে এজেন্ট, ডিলার সহ শত-শত খুচরা বিক্রেতারা।

ডিসেম্বর থেকে ঝড় চলছে ভারত থেকে আমদানিকৃত বাস-ট্রাকের টায়ারের বাজারে। সেই ঝড়ে পুরো টায়ারের বাজারের স্বাভাবিক ক্রয়-বিক্রয় থমকে গেছে।

আমদানিকারক ও বাজার সূত্র জানায়, করোনা মহামারীর জোয়ার ভাটার মধ্যে সারাবিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের সৃষ্ট অচলাবস্থা টায়ার বাজারের মধ্যে এখনও চলমান রয়েছে।সম্প্রতি মার্কিন ডলার ও অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি জাহাজের কনটেইনার ভাড়ায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানিকৃত সকল পণ্যের পাশাপাশি প্রায় সব টায়ারের দাম এখনও ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা বিরাজ করছে।

বর্তমানে আমদানিকৃত টায়ারের বাজারের সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ভারত ও চায়না টায়ার। ভারতের বায়াস (সুতা) এবং চায়না রেডিয়াল (তার) টায়ারের বাস-ট্রাকের বাজার সিংহভাগ নিজেদের দখলে রেখেছে।

দেশে বাস-ট্রাকের বায়াস টায়ারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ১০০০-২০(এম৭৭) এমআরএফ টায়ারটি অনেকটাই একক ভাবে বাজারে তার স্বকীয় অবস্থান ধরে রেখেছে । এই টায়ারটির দামের উঠা-নামার সাথে বাজারে অন্যান্য অনেক বায়াস এবং রেডিয়াল টায়ারের দাম উঠা-নামার যোগ সুত্র রয়েছে।

টায়ার ব্যবসায়ীরা জানান, এমআরএফ ইন্ডিয়া দীর্ঘদিন থেকে বেশ কয়েকজন এজেন্টের (ডিস্ট্রিবিউটার) মাধ্যমে এদেশে তার টায়ার গুলো বাজারজাত করে আসছে । করোনাকালের টায়ারের স্বল্পতা কারনে হঠাৎ দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে । সে সময় প্রতি টায়ারের দাম প্রায় সর্বোচ্চ ২৯ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। টায়ারের স্বল্পতা ও অত্যধিক দাম বৃদ্ধি কারণে MRF এর নির্ধারিত এজেন্ট এর বাইরে ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী(যারা থার্ড পার্টি হিসাবে পরিচিত) কলকাতা থেকে সামান্য পরিমাণ টায়ার এনে বিক্রি করলেও তখন বাজারে এর তেমন কোন প্রভাব পড়ে নাই। তবে গত ডিসেম্বরে প্রচুর পরিমাণে এমআরএফ টায়ার বাজারে ঢুকলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

কাস্টম সূত্র জানায়, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে (কোয়ার্টারের) ডিস্ট্রিবিউটারেদর মাধ্যমে সমুদ্র পথে এমআরএফ এর TBB টায়ার আসে প্রায় ২৫ হাজার ৯০০ সেট এবং TBR আসে আছে ৯ হাজার৬শ সেট। তাছাড়া স্থলপথে দিয়ে শুধু ডিসেম্বরেই ১হাজার ১শত এমআরএফ TBR টায়ার প্রবেশ করে। মুলত স্থল পথের এই টায়ার গুলোকে বলা হয়ে থাকে (থার্ড পার্টি) টায়ার। এমআরএফ এর ইতিহাসে স্থলপথে দিয়ে এতো বিপুল পরিমাণ থার্ড পার্টির টায়ার আগে কখনো আসেনি। এক মাসে ১১শত সেট টায়ার আসাটাকে অনেকেই ঝড় বলছে।

গত বছর করোনার বিভিন্ন ভেরিয়েন্টের সময় থেকে ভারতের টায়ার কারখানার উৎপাদন স্বল্পতার কারণে বাজারে দাম ছিল সব সময় ঊর্ধ্বমুখী। তার উপর সম্প্রতি অপরিশোধিত তেল এবং মার্কিন ডলার ও জাহাজের কন্টেইনারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে যেখানে টায়ার সহ সব আমদানি পন্যের দাম বাড়াছে সেখানে শুধু ব্যতিক্রম বাস-ট্রাকের এমআরএফ টায়ারের দাম। এই টায়ারের দাম প্রতিদিনই কমছে।

অন্যদিকে বাজার সূত্র জানায়, থার্ড-পার্টির বিপুল পরিমাণ টায়ার আসার বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার কারনে দাম পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কার আগে, কে-পুরানো স্টক, কম দামে বিক্রি কারে বেরিয়ে যাবে, তা নিয়ে চলছে সব পক্ষের (থার্ড পার্টি, এজেন্ট, ডিলার দোকানদার) প্রতিযোগিতা।

শিপিং সূত্র জানায়, আগে যেখানে ভারতের বিভিন্ন বন্দর থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দরে জাহাজ ভাড়া ছিল ৪০ ফুটের কনটেইনার ১২শত মার্কিন ডলার তা এখন বেড়ে ৩৬শত মার্কিন ডলার এসে ঠেকেছে। তবে এই ভাড়া আরও বাড়তে পারে বলে তারা জানায়।

তবে এমআরএফ এর আমদানিকারক সূত্রে জানায়, ১০০০-২০-১৬(এম৭৭) টায়ার আমদানিতে বর্তমান বাজারের দাম থেকে প্রায় এক হাজার টাকা বেশী দিয় এজেন্টদের টায়ার আনতে হয়। তাহলে থার্ড পার্টিরা কিভাবে কম দামে টায়ার বিক্রি করে? এই প্রশ্নের জবাবে আমদানিকারকরা জানান, ভারতের কলকাতা থেকে সীমান্ত দিয়ে আসা টায়ারে প্রায় আড়াই হাজার ডলারের অতিরিক্ত কনটেইনার ভাড়া না লাগার কারণে তারা দামের দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

তাছাড়া গত বছর দেশের বাজারে বেশ কয়েক মাস ধরে এমআরএফ টায়ারের কৃত্রিম ভাবে মূল্যবৃদ্ধির কারণে থার্ড-পার্টিরা এমআরএফ টায়ার এনে ভাল মুনাফা অর্জন করায় এখন এজেন্টদের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা সুবিধাজনক আবস্থানে রয়েছে।

গত দেড় মাস ধরে এজেন্টরা বন্দরের সার চার্জ, ব্যাংক ইন্টারেস্ট, সহ লোকসান দেবার কারণে বড় বিপদে রয়েছে । এ ব্যাপারে এজেন্টরা সবাই এক হয়ে MRF INDIA কে চিঠি দিলোও এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না বলে জানান।

বাজার সূত্র জানায়, আগে ঢাকার ২/১ জন (থার্ড পার্টি) ব্যবসায়ীরা স্থল পথে টায়ার আনলেও বর্তমানে ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সান্তাহার, রাজশাহীসহ মোট পাঁচজন ব্যবসায়ী কলকাতা থেকে বিপুল পরিমাণে টায়ার নিয়ে আসছে।

কলকাতার অন্যতম একটা বৃহত্তম টায়ার বিক্রেতা, যার এক্সপোর্ট লাইসেন্স রয়েছে, যে মাসিক সাড়ে তিন কোটি টাকা শুধু এমআরএফ টায়ারই বিক্রি করে। এবং যার নামের প্রথম অক্ষর “ই” দিয়ে শুরু। তিনি এই এমআরএফ টায়ার গুলো সরবরাহ করে থাকেন বলে বিভিন্ন সুত্র জানায়।

বাজারে অন্য একটি সূত্র জানায়, করোনা সময় টায়ার স্বল্পতার কারণে হঠাৎ এম আর এফ এর উচ্চ মূল্য বৃদ্ধিতে এজেন্টরা এমআরএফ ইন্ডিয়া কর্তৃক মূল্য তালিকা (কম দামে) টায়ার বিক্রির পরিবর্তে খোলাবাজারে অধিক লাভের আশায় যে বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে তার কারণে থার্ড পার্টিরা টায়ার আনতে উৎসাহিত হয়েছে। তা ছাড়া গোপনে এবং প্রকাশ্যেই এজেন্ট এর মূল্য তালিকা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। মূলত গত এক বছর ধরে MRF বাজার ছিল শৃঙ্খলাহীন। বাজার মনিটর করা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও ছিল চরম উদাসীন।

দেশের বাজারে এমআরএফ দামের ছন্দপতনের ঘটনায় ভারতীয় অন্যান্য ব্র্যান্ডের সংশ্লিষ্টরা কর্তাব্যাক্তিরা বর্তমানে প্রতি মুহূর্তে বাজার মনিটরিং করছে। MRF এর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটল কেন? এই প্রসঙ্গে তারা জানান, সীমান্ত দিয়ে নির্ধারিত ডিস্ট্রিবিউটারের বাইরে এত বিপুল পরিমাণ টায়ার আসা খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। ভারতের খুবই নামকরা এবং বড় টায়ার উৎপাদনকারী হিসেবে এমআরএফ ইন্ডিয়া প্রতি মুহূর্তে তাদের মার্কেট শেয়ার, দাম, রপ্তানির যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে। সেখানে ডিস্ট্রিবিউটারের বাইরে এত বিপুল পরিমাণ টায়ার কিভাবে দেশে আসে এটা অনেক বড় প্রশ্ন? ভারতীয় কোন রপ্তানিকারক কিংবা বাংলাদেশের কোন আমদানিকারক MRF ইন্ডিয়ার অজ্ঞাতসারে এত বিপুল টায়ারের লেনদেন করতে পারাটা অনেক কৌতুহল এর জন্ম দিয়েছে । তাছাড়া গত বছর দীর্ঘ সময় কলকাতায় তাদের দেশীয় এজেন্টদের আবস্থান, কলকাতা থেকে বিপুল পরিমাণ টায়ার আনা, দেশের বড়-বড় টায়ার ট্রেডারের বাইরে নতুন নতুন থার্ড পার্টিরা সৃষ্টি করা, দেশের বিভিন্ন ডিলার পয়েন্টে গিয়ে বলা হয়েছে, MRF বিক্রি হল বড় কথা, কোত্থেকে নিবেন সেটা বড় নয়,। ইত্যাদি ঘটনার অনেক কিন্তুর জন্ম দিয়েছে বলে তারা জানান।

বাজারে অন্য একটি সূত্র জানায়, করোনাকালের টায়ারের উৎপাদন স্বল্পতার কারণে এমআরএফ দেশের বাজারে যতটুকু শেয়ার হারিয়েছিল, তা বর্তমানে আবার পূরণ করতে চলেছে। কমদাম হওয়ার কারণে বাজারে এখন এমআরএফ টায়ার তুলনামূলক বেশি চলছে। বেশী করে এমআরএফ টায়ার চলার জন্য এটা নতুন কেন মেকানিজম কি-না ? সেটা বলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

অন্য একটি সূত্র জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকায় এমআরএফ ডিস্ট্রিবিউটার ভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সবার সাথে ব্যবসা করার বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সেখানে যারা চাইছে তাদেরকে সরাসরি ভারত থেকে এমআরএফ টায়ার পাঠানোর মাধ্যমে বাজার গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশেরও এমআরএফ সব দোকানদারের সাথে ব্যবসা করার বাজারভিত্তিক প্রচেষ্টা শুরু করার জন্য ২/৩ বছর আগে একবার আলোচনা তুলেছিল। এই প্রক্রিয়ায়, সব দোকানদারই ডিলার। ডিলার শুধু কাস্টমার (ব্যবহারকারীদের) কাছে টায়ার বিক্রি করবে। দোকানদার-দোকানদারের কাছে এমআরএফ বিক্রি করার দরকার প্রয়োজন নেই। কারণ এমআরএফই সবার কাছে টায়ার সরবরাহ করবে। তবে এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু করা যায়নি।

এদিকে করোনার শেষ সময়ে নতুন বাজার ব্যবস্থায় এমআরএফ এদেশে আগের এজেন্টদের পাশাপাশি কিংবা নতুন করে বড় কোন পার্টনার সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে বাজারে যে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে, তা দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত আলোচিত ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড এমআরএফ নিয়ে অনেক আলোচনা চলবে বলে অনেকেই মনে করেন।

এমআরএফ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে এমআরএফ ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ প্রতিনিধি মিস্টার রোহিত মন্ডল জানান, অভিযোগগুলো সঠিক নয় । তবে এ ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

থার্ড পার্টি ও এজেন্টদের প্রতিযোগিতায় শত শত ডিলার ও সহস্রাদিক দোকানদার সহ সবাই কমবেশি সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেশি বিক্রিত কারণে লাভ হচ্ছে কিন্তু এমআরএফ টায়ারের। মাঠ পর্যায়ে প্রায় সবাইকে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত করে নতুন বিকল্প বাজার ব্যবস্থা ভবিষ্যতে’ সুষ্ঠু বাজার প্রক্রিয়ার জন্য অশনিসংকেত বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।##

আরও পড়ুন
- Advertisment -spot_img

সর্বশেষ