“আমার দাদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তিঁনি চেয়েছিলেন আমার বাবা যেন পুলিশে যোগ দেয়। কিন্তু বাবা পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতাকে। পুলিশ পেশার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে জীবদ্দশায় দাদা চাইতেন, তাঁর পরিবারের কেউ যেন পুলিশে যায়। কিন্তু আমি পুলিশে চাকুরী করবো, তা দাদা জীবিত থাকা অবস্থায় কখনোই কল্পনা করেনি। আমিও বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশে যাওয়ার কথা কখনো চিন্তাও করিনি। আমিও চেয়েছিলাম বাবা মত আদর্শবান শিক্ষক হতে। বিসিএস দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চেয়েছি।
বহুল আলোচিত ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার ফর্মে আমি শিক্ষা, পররাষ্ট্র ও পুলিশ সহ ৭ বিষয়ে চয়েজ দেই। প্রিলির পর লিখিত পরীক্ষায় আমি উভয় ক্যাডার উত্তীর্ণ হয়ে পররাষ্ট্র পাওয়ার জন্য নিজেকে ভাইভার জন্য তৈরি করি। ভাইভাতেও আমাকে বেশিরভাগ প্রশ্ন করা হয় পররাষ্ট্র কেন্দ্রিক। পরে ভাইভা বোর্ড আমাকে পুলিশ ক্যাডারের জন্য সুপারিশ করে।
সেই রেজাল্ট দেওয়ার দুইদিন পরে ৩৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় আমি অংশ নেই। তা পাস করার পর ভাইভা বোর্ডে আমার পররাষ্ট্রে আগ্রহের বিষয়টি উপস্থাপন করি। বোর্ড আমাকে ৩৪তম বিসিএসে পুলিশে যোগ দিব না লিখিত দেওয়ার কথা জানালে, আমি অপারগতা প্রকাশ করি। সেই সময়ই প্রথম মনে হয়েছে যে, আমার মরহুম দাদার অপূর্ণতা পূরণে আমার ভাগ্য পুলিশে লেখা হয়ে গেছে।”
উপরে পুলিশে আসার গল্পটি বাংলাদেশ পুলিশের এডিশনাল এসপি আকলিমা আক্তারের। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মালির মিনুসমাতে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
২০১৬ সালের জুন মাসে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে যোগ দিয়ে আকলিমা আক্তার রাজশাহীর সারদায় দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি’ থেকে আইন-শৃঙ্খলার উপর মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। পুলিশের কর্মজীবনে প্রথম পোস্টিং পান রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় চট্টগ্রামে।
সেখানে তিনি এএসপি (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস্), ষ্টাফ অফিসার টু ডিআইজি, এএসপি (এ্যাডমিন) হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। চাকুরীর অংশ হিসেবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ২০১৯ সালে ভারতের গাজিয়াবাদে অবস্থিত সিবিআইর প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
২০২২ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন। দীর্ঘ চার মাস টাংগাইলের পিটিসিতে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে চুড়ান্তভাবে মনোনীত হন। ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পুলিশের এডিশনাল এসপি আকলিমা আক্তার জাতিসংঘের শান্তি মিশনের অধীনে আফ্রিকার মালির বামাকোর মিনুসমাতে কর্মরত রয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশ পুলিশ কন্টিনজেন্টের পুলিশ ইউনিটে (বেনএপপিও-১) রোটেশন-৯ এর প্লাটুন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার জমিদার হাটস্থ লতিফপুর গ্রামের ১৩নং রসুলপুর ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্ম নেন আকলিমা আক্তার। শিক্ষক পিতা মীর মোহাম্মদ আবদুল হাই আলমগীরের চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামের মোহরা এবং নোয়াখালীর চৌমুহনীতে শৈশবে বেড়ে ওঠেন তিনি। চৌমুহনীর মদন মোহন হাই স্কুল থেকে মেট্রিক ও চৌমুহনী সরকারী এস এ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স এবং পরে আইআইইউসি থেকে বিবিএ এবং ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সে উপর এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রথম দিকে তিনি শিক্ষকতা করার মানসিকতা নিয়ে চট্টগ্রামের ব্রিটিশ ক্যারিকুলাম সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যোগ দেন এবং পরে সরকারি হাজী মো: মহসিন কলেজে বেসরকারি ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি তিনি বিসিএস পরীক্ষা অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। ৩৪তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারের যোগ দিয়ে তিনি রাজশাহীর সারদা থাকাকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “এমপিএস ফ্যাকাল্টি অব ল” উপরে তৃতীয় মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন।
স্বামী, দুই সন্তান সহ পরিবার নিয়ে দীর্ঘ পথ চলা তার জন্য কখনোই মসৃণ ছিল না। বিয়ের পর-পর সন্তান নিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসার সামলানোর পরও সরকারী ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ দুটি ডিগ্রি নিয়েও ভালো চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন হলেও তিনি কখনো আত্মবিশ্বাস হারান নি।
দুই ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় হলেন আকলিমা আক্তার। ভাইদের মধ্য বড়, আব্দুল্লাহ্ আল মামুন পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে ঢাকায় উত্তরার ব্যবসায়ী, ছোট ভাই ডাঃ আব্দুল্লাহ্ আল নোমান ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত। একমাত্র ছোট বোন আয়েশা আক্তার সুমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রবাসী। মফস্বল শহরের সামাজিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও স্কুলে থাকাকালিন মা বিবি মরিয়মের প্রেরণায় গান, কবিতা আবৃত্তি সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে দেশের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া দাদা পুলিশ কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ মিয়া এবং নানা বিডিআরের প্রাক্তন সদস্য ও সরকারি গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রবের সুযোগ্য নাতনী হয়ে “মুক্তিযোদ্ধা কোটা” পাওয়ার চেষ্টা না করে আকলিমা আক্তার সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে মেধার ভিত্তিতে বিসিএসে উন্নীত হয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
শুধুমাত্র শিক্ষকতা পেশায় উৎসর্গ করা মরহুম পিতার আদর্শ ধারণ করে আগামীর পথে এগিয়ে চলছেন তিনি। পুলিশে যোগ দিয়ে দাদার মতো মানব সেবার প্রত্যয় নিয়ে সকলের আশীর্বাদ কামনা করছেন। দাদার অপূর্ণতা পূরণ করতে পেরে আকলিমা আক্তার এখন নিজেকে সবচেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান মনে করেন।###