শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদমুক্তিযুদ্ধনয় মাসের প্রতীক্ষা ।। বিজয়ী বেশে ফিরে এলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব।।

নয় মাসের প্রতীক্ষা ।। বিজয়ী বেশে ফিরে এলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব।।

প্রতিদিন ভোর হয় আকাশের পুরো দেহে লাল আভা ছড়িয়ে। ক্ষনিকের দিনগুলো মহাকালের অতল গহবরে হারিয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো আজও প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে এক গৃহবধু, দেখেছে দূর আকাশ। কখনো ভোরের কুয়াশা, কখনো বৃষ্টি কখনো বা স্নিগ্ধ বাতাস। সম্ভ্রান্ত মুসলিম সৈয়দ পরিবার থেকে উঠে আসা সংগ্রামী বিদুষী নারী ঋতুর এই পরিবর্তন দেখে দেখে আজ বড়ই ক্লান্ত। ফজর নামাজ পড়ে সুবহে সাদেকের আলো আধারের মাঝে বাড়ির দরজা খুলে উঠানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত সৈয়দা নুর জাহান বেগম। শ্বশুর বাড়িতে সংসার সামলানো তার নিত্যদিনের কাজ। কেটে গেছে অনেক বছর। কিন্তু যার জন্য এ বাড়িতে, তিনি কোথায়?

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পর আজও স্বামী ইপিআর(তৎকালীন)-এর সৈনিক মো: আব্দুর রবের কোন খোঁজ নেই। বেঁচে আছি কিনা তাও কেউ বলতে পারতেছে না।

ফেনী-নোয়াখালী হাইওয়ের বেগমগঞ্জ থানার জমিদারহাটস্থ ১৩ নং রসুলপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ লতিফপুর গ্রামের আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া বাড়িটি মূল সড়কের কয়েক মাইল ভেতরে হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিধ্বনিতে পুরো এলাকাটিকে প্রকম্পিত করে রেখেছে। কয়েকদিন ধরে কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বিজয় উল্লাসের স্পন্দন লেগেছে লোকালয়ে প্রতিটি ঘরে।

তবে নয় মাসের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে নুরজাহান বেগমকে। কারণ তার স্বামীএখনো নিখোঁজ । সবারই ভালো/খারাপ খবর আসে, তার স্বামী ছাড়া। যুদ্ধের ভেতর কয়েকবার শুধু জেনেছে স্বামী যুদ্ধ গেছে, এর বাইরে কেউ কিছু জানে না।

সে সময় মাঝে-মাঝে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা স্বামীর খোঁজে বাড়িতে তল্লাশি চালাতো। তখন নুরজাহান বেগম তার ছোট-ছোট, ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে কখনো ধানের গোলায়, কখনো পুকুরে, কখনো ধান ক্ষেতে, কখনো খাল-বিলের কচুরিপানার ভেতর লুকিয়ে আশ্রয় নিতো। সবাইকে নিয়ে সারাক্ষণ থাকত উৎকন্ঠায়। সে এক ভয়াবহ সময় পার করতে হয়েছে নুরজাহানকে।

এই কয় মাসে নুর জাহান বেগমের চেনা জানা জগত পুরোটাই অচেনা হয়ে গেছে । পরিচিত লোকজন, পারিপার্শ্বিকতা, চেনা জানা সবকিছু হঠাৎ বদলে গেছে। যে স্বামীর জন্য এত বছর এই বাড়িতে, সেই স্বামী আজ তার পাশে নেই।

হঠাৎ সামনে ঝাপসা কিছু একটা দেখে চমকে গেলেন নূর জাহান । মনে হল কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে। কেমন জানি চেনা-চেনা লাগছে। ছবি স্পষ্ট হতে বিস্ময়ভাবে শুধু দাঁড়িয়ে থাকল। হাত পায়ের সমস্ত শক্তি যেন নিঃস্ব হয়ে গেছে। শরীরের পাশাপাশি, কণ্ঠেও আজ আর কোন শব্দ নেই । আগত ব্যাক্তির কণ্ঠস্বর শুনেই নিশ্চিত হয়ে গেল, সামনের লোকটি গত নয় মাসে হারিয়ে যাওয়া তার প্রাণপ্রিয় স্বামী আব্দুর রব। আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে। ময়লা জামা কাপড় পরিবেষ্টিত বিধ্বস্ত লোকটির চোখে মুখে বিজয়ের হাসি। যুদ্ধে বিজয়ী বেশে তিনি আজ বাড়ি ফিরেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশাপাশি পিলখানাস্থ তৎকালীন ইপিআরের
সদর দপ্তর আক্রমণ চালায়। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ইপিআরের ১২ হাজার  বাঙালি সৈনিক প্রতিরোধ শুরু করে। তখন ইপিআরের সদস্যরা অন্যান্য বাহিনী
সহ মুক্তিকামী মানুষের সাথে সংগঠিত হয়ে স্বাধীনতার জন্য ১১টি সেক্টরে ৯ মাস ব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা করে।

যশোর ক্যাম্পে উনচল্লিশ বছর বয়সী ইপিআরের নায়েক সুবেদার মো: আব্দুর রব সহ বাঙালিরা ঢাকায় ইপিআর সদর দপ্তর আক্রমণের খবর শোনার পর থেকেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। প্রতিশোধের আগুন ইপিআরের সৈনিকদের মাঝে জ্বলে ওঠে।

এদিকে গত ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর ক্যাম্পে অস্থিরতা বাড়ে। যশোরে এই ইপিআরের ক্যাম্পে পাকিস্তানী সৈনিকরা ১০ জন থাকলেও বাঙালি সৈনিকরা ছিল ১৫ জন ।ক্যাম্পে ডিউটি করার সময় পাকিস্তানীরা সবার সাথে উর্দুতে কথা বলতো। বাঙালিরা পাকিস্তানীদের সাথে উর্দুতে কথা বললেও স্বজাতির সাথে বাঙালিরা কথা বলতো বাংলায়। তখন ইপিআরে বাঙালীরা ছিল খুবই কম । উধ্বর্তন কর্মকর্তা ছিল হাতে গোনা। বাঙালীদের মধ্যে উধ্বর্তন কর্মকর্তা ছিল ক্যাপ্টেন পদমর্যদা পর্যন্ত। তবে দীর্ঘদিন পাকিস্তানী ও বাঙালি সৈনিকরা একসাথে থাকতে-থাকতে ক্রমেই তাদের মধ্য অফিসিয়ালি সম্পর্কের বাইরে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

কিন্তু ১৯৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানীদের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। তারা বাঙালিদের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক নেতারা সোচ্চার হতে থাকলে এ দূরত্বও বেড়ে যায়।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায় । ক্যাম্পে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ।শুরু হয় অবিশ্বাসের চূড়ান্ত অধ্যায় ।

তখনকার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মো: আব্দুর রব তার স্মৃতিচারণে বলেন, “তারা (পাকিস্তানী) আমাদের (বাঙালিদের) অনুসরণ করত, আমরাও তাদের অনুসরণ করি। তখন থেকে আমরা বিদ্রোহ করার মনস্থির করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। আমাদের (ইপিআরের বাঙালি সৈনিকদের) মনে হয়েছিল পাকিস্তানীদের থেকে বাঙালিরা মুক্ত না হলে এ দেশ তাদের দখলে চলে যাবে। তারা আমাদের আজীবন শোষণ করার জন্য সবকিছু দখল করে নিয়ে যাবে। তাই আমরা বিদ্রোহ করার চিন্তা করি। এই সময় সারা দেশের মতো আমাদের সৈনিকদের মধ্যেও স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়।

২৫ শে মার্চ পিলখানা হামলার পর থেকে প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন বিস্ফোরিত অবস্থায় আমাদের কাছে রাজনৈতিক বার্তা আসতে থাকে, বিদ্রোহ করার। তখন আমরা ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিরস্ত্র করার সুযোগ খুঁজি । অন্যদিকে তারাও আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে আমাদের খতম করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। এই সময় একে অন্যকে খতম করার জন্য আমরা উভয় মত্ত হয়ে থাকি।

এত কাল পাশাপাশি থাকা ভিন্ন জাতির সহকর্মী বন্ধুরা আজ নিজ-নিজ দেশের টানে একে অন্যের চিরশত্রুতে পরিণত হয়েছে। একই ক্যাম্পে দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে টানটান উত্তেজনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার শেষ চেষ্টায় তখন অপেক্ষারত আমরা।

এক সময় আমরা বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে প্রথম অপারেশন পাকিস্তান বাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানি। আক্রমনে পাকিস্তান বাহিনীর সাতজনকে আমরা ঘায়েল করে হত্যা করি। এরপর আমরা ক্যাম্প থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসি।

ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসার পর আমরা যশোর থেকে ঝিকরগাছা যাই। পথে-পথে বিভিন্ন বাহিনীর বাঙালি সৈন্য, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ আমাদের সাথে যোগ দেয়। এই সময় কখনো ২০ জনের গ্রুপ, কখনো ৫০ জনের গ্রুপ করে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের (হাঁটা যুদ্ধ) অপারেশন শুরু করি। । প্রায় প্রতিটি অপারেশনে তাদের হতাহতের সংখ্যা বেশি থাকলেও, আমাদেরও ২/৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হতো।

এপ্রিলের প্রথম দিকে আমরা যশোর যাই । ওই সময় যশোরের আর্মি ক্যাম্পের পাশে আমিন খান নামে এক পাকিস্তানি ব্যবসায়ী তিনতলা ভবনে বাস করত। এই আমিন খান ও তার ছেলে পুরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি কায়েম করে রেখেছিল। নিরীহ মানুষদের হত্যা, বাড়িঘর পোড়ানো, লুটপাট, নারীদের সম্ভ্রমন হানির কারণে পুরো এলাকায় তাদের ওপর মানুষের তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছিল। এইসব তথ্য আমাদের কাছে আসার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই সেখানে অপারেশন চালানোর জন্য।

৪০ থেকে ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে নিয়ে রাতে যাই ডিফেন্স করার জন্য। রাতে একশ থেকে দেড়শ মিটার দূরে বাঁশ বাগানের জঙ্গলে আমরা বাংকার করে অপারেশন শুরু করি। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি। আমরা ভবনের দিকে গুলি করি, তারা ভবন থেকে আমাদের দিকে গুলি করে।

আমরা বাংকার করে নিরাপদে ছিলাম বলে তাদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হত। ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত চলে অবিরাম যুদ্ধ। এক সময় ভবনের ভিতর থেকে গুলি করা থেমে যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, আমরা ভবনের দিকে যেতে থাকি। ৪ ঘন্টার যুদ্ধে পাকিস্তানি অত্যাচারীরা পরাজিত হয়েছে এই ভেবে ভবনের বাইরে একটু দূরে থেকে বিপুল জনতা ভবনটিকে ঘিরে রাখে। তাদের সেই উত্তেজনার আওয়াজ আমরাও শুনতে পাচ্ছিলাম।

ক্রলিং করে আমরা আস্তে-আস্তে ভবনের কাছে যাই। মূল দরজার কাছে আমরা অস্ত্র তাক করে ৪/৫ মিনিট অপেক্ষা করি। এরপর এক গ্রুপ দরজা লাথি মেরে খুলে ফেলি। নিচ তলায় রুমগুলো খালি সেখানে কেউ নেই। খুবই সাবধানে ১/২ একটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলা যাই। দোতালায় অনেকগুলো কামরায় তল্লাশি করতে গিয়ে একটা রুমের দরজা খুলতেই আমরা শিউরে উঠি।

সেখানে তিন বাঙালি নারী, এক শিশু সহ চারজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। এক যুবতী তার কোলের বাচ্চাকে দুধ খাওয়ার ভঙ্গিতে পড়ে আছে। বাচ্চার মাথা দিয়ে গুলি বেরিয়ে নারীর বুকেও বিদ্ধ হয়েছে। বাচ্চার মাথা ছিন্ন ভিন্ন শুধু ছোট্ট শরীরটাই তার মায়ের বুকের মধ্যে পড়ে আছে। মৃত দেহ দুটি দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মা তার সন্তানকে এখনো দুধ খাওয়াচ্ছে।
একটু দূরে পড়ে আছে সদ্য বিবাহিত যুবতী গুলিবিদ্ধ মরদেহ। মেয়েটার হাতের মেহেদীর দাগ তখনও স্পষ্ট। তার পাশে এক কিশোরী। কিশোরীর পরিদেহ বস্ত্র ছিন্নবিন্ন। সম্ভ্রম বাঁচাতে হয়তো যুদ্ধ করেছিল। তার মুখে কৈশোরের মায়াবী ছাপ তখনো স্পষ্ট।

রক্তে পুরো রুম ভাসছে। রক্তগুলো জমাট বাঁধা,হয়তো ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা আগে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। তিনতলা তল্লাশি চালিয়ে আমিন খান সহ তার পাঁচজন দোসরদের পাকড়াও করি।

তবে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী আমিন খানের ছেলেকে আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকি। সে ছিল নারী নির্যাতন, লুটপাট, সহ জঘন্য ধরনের কর্মকান্ডের নেতা। তিন তালার উপরে একটি কক্ষে ছিল আমিন খানের ছেলের রঙ্গমঞ্চ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমির খানের ছেলেকে পাওয়া গেল না। তবে টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে মিললে আমির খানের স্ত্রীকে। তিনি চুল এলোমেলো করে বাথরুমে বসে ছিলেন।

ভবনের ভিতর আমাদের অভিযানের সময় এলাকার শত শত মানুষ অপেক্ষা না করেই, ভবনে দুই তলা পর্যন্ত উঠে যায়। দোতলায় নির্যাতিত মৃতদেহের রুমের সামনে ভীড় ছিল বেশি। মৃত নারীদের স্বজনদের কান্না ও চিৎকার আমরা উপর থেকে স্পষ্ট শুনতে পাই।

স্বচক্ষে নির্যাতিত মৃত নারীদের বিভৎস দৃশ্য দেখে ঘেরাও করা জনতা চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আটক করে তিন তলা থেকে দোতালা নামিয়ে আনার সময় সিঁড়ির মধ্যে থাকা উত্তেজিত জনতা মুহূর্তে আমাদের কাছ থেকে ছোঁ মেরে আমিন খানকে নিয়ে যায়। তীব্র জনরোষের মধ্যে পড়ে আমিন খান আর বেশিক্ষণ বাঁচতে পারেনি।

এই অপারেশন শেষ করে আমরা হাঁটা পথে ঝিকরগাছা দিয়ে সীমান্তবর্তী বেনাপোলের দিকে এগুতে থাকি। কারণ আমাদের কাছে নির্দেশ আসে সীমান্ত অতিক্রম করার। আমরা ৪০/৫০ জন বিভিন্ন বাহিনী সহ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপ করে হাটতে থাকি। সে সময় সাধারণ মানুষও আমাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাটতো। দূর থেকে মনে হতো বিশাল মিছিল শুধু এগিয়ে চলছে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি আমরা বেনাপোলে পৌঁছে সেখানে এক রাত ছিলাম। সেখানে খবর আসে সাতক্ষীরা যাওয়ার। আমরা সকালে কলারোয়া দিয়ে সাতক্ষীরা যাই।

সাতক্ষীরা টাউনে পাকিস্তানী বাহিনীর এক কোম্পানি অবস্থান করছে। গভীর রাতে সেখানে বেড়িবাঁধের উপর আমরা ৪০/৫০ জন ডিফেন্স নেই। বেড়িবাধের পাশের খালটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ও ভারতের সীমান্তবর্তী। জোয়ার আসলে পানি কোমর পর্যন্ত উঠে। ভাটায় হেঁটে পার হওয়া যেত।

পাকিস্তানি ক্যাম্প এবং আমাদের অবস্থানের মাঝখানে আঁখ ক্ষেত। ক্ষেতের ভেতর হাঁটা যায়। আমাদের অবস্থান পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে স্পষ্ট হতেই তারা আক্রমণ শুরু করে। মুহূর্মুহূ গুলির কারণে আঁখ গাছের উপর পাতা গুলো উপর দিয়ে উড়ছিল। মাঝে-মাঝে তারা আঁখ ক্ষেতের ভেতর ঢুকে কিছুটা ভয়ে এলোপাথাড়ি আমাদের উপর আক্রমন করছিল। তাদের হাতে ছিল তখনকার সব অত্যাধুনিক অস্ত্র। অন্যদিকে আমাদের কাছে ছিল সাধারণ অস্ত্র। ভোর ৬টা থেকে বেলা ৮ টা পর্যন্ত ২ ঘন্টার তুমুল  যুদ্ধে আমাদের ৩জন এবং পাকিস্তানে ১২ জন মারা যায়।

আমাদের তিনজন শহীদের মধ্যে ছিল নোয়াখালীর জমিদারহাটের পাশের গ্রামের হাবিলদার মমতাজ। তার লাশ আমরা আনতে পারিনি। বরিশালের নায়েক সুবাদার আবু আহমেদের পেটে গুলি লাগে। অপর জন হল কুমিল্লার সুবেদার জেই আহমেদ।

এপ্রিলের শেষ দিকে আমরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর, কলারোয়া, ঝিকরগাছার বিভিন্ন স্থানে অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হই।

এই সময় ঝিকরগাছায় এক অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের উপর বিপুল সংখ্যক মেশিনগান দিয়ে আঘাত হানে । আমরা তাদের আক্রমণে ঠিকতে না পেরে সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাই।”

মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ আট মাস আব্দুর রব ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা গুলোতে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন । নামকরা ভুঁইয়া পরিবার থেকে উঠে আসা আব্দুর রব দক্ষ সৈনিক হিসেবে ইপিআরে যে সুনাম অর্জন করেন, তার সবটুকু তিনি যুদ্ধের কৌশলে প্রয়োগ করে সফলতাও পান।

৮ নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাযুদ্ধে তৎকালীন ইপিআরের ৮০০জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফ।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় বহু মানুষের আত্মাহূতি ও স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি বিভিন্ন অপারেশনে ব্যস্ত ছিলেন।  তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি স্বজনদের খোঁজ নিতে পারেননি । তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি  প্রিয়জনের খোঁজে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

মো: ইউনুস মিয়া ও আরাফাতের নেছার ২য় সন্তান আব্দুর রব ৪ ছেলে ৩ মেয়ের গর্বিত জনক। তাই আপনজনের টানে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকার পরও তিনি সুদূর যশোর থেকে অনেকটা পায়ে হেঁটে কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় খুব ভোরে অবশেষে বাড়ি ফিরেন। নিজের বাড়ির উঠানে উঠতে গিয়ে দেখেন তার সহধর্মিনী নুরজাহান তারই জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। প্রিয়তমার সেই প্রতীক্ষারত উদ্বেগ তাড়িত মুখে হাসির ঝলক একানব্বই বছর বয়সে এসেও আব্দুর রব এখনো ভুলতে পারেননি।##

জ্ঞাতার্থে:-
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (অবসরপ্রাপ্ত) নায়েক সুবেদার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মো: আব্দুর রবের মুক্তিযুদ্ধের সম্মানজনক স্বীকৃতির তথ্য সমূহ :- “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট নং ৬১২, মুক্তিবার্তা লাল বই নং ০২০৯০২০৯৯২, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা খন্ড নং ৪, ক্রমিক নং ২৮৮৪৮। মুক্তিযোদ্ধা মো: আব্দুর রব ও সৈয়দা নুর জাহান বেগমের ৭ সন্তানরা হলেন:- সৈয়দ মো: আবু জাহের, মোঃ গোলাম মাওলা ভুঁইয়া, বিবি মরিয়ম, পারুল বেগম, হুমায়ুন কবির, মো: গোলাম কিবরিয়া ও ফাতেমা আক্তার”। ###

আরও পড়ুন
- Advertisment -spot_img

সর্বশেষ