শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদরাজনীতি৮ ই আগস্ট ঐতিহাসিক দিন।। শোকার্ত মানুষের নতুন করে স্বপ্ন দেখা।।

৮ ই আগস্ট ঐতিহাসিক দিন।। শোকার্ত মানুষের নতুন করে স্বপ্ন দেখা।।

৮ ই আগস্ট ছিল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত হওয়া দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহাসিক দিন।

গত ২৪ দিনের মত গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সারাদেশের শোকার্ত মানুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। চরম অনিশ্চিত পরিবেশে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে আশার আলোর । তাই শোকার্ত মানুষ আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ডক্টর ইউনুস বলেছিলেন, “আজ আমার আবু সাইদের কথা মনে পড়ছে। অবিশ্বাস্য একটা সাহসী যুবক। যে আবু সাইদের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে”। কথাগুলো বলতে বলতে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের কন্ঠ কাঁপছিল। পরে তিনি কেঁদেই ফেলেন। তখন তার চারিপাশে  বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরাও কাঁদলেন। ডক্টর ইউনুসকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে আগত সবাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, গত ১৬ই জুলাই রংপুরে আবু সাইদের উপর পুলিশের গুলি করার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার বিদায় নেয়। এবং ৮ আগস্ট রাতে এই নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা বঙ্গভবনে শপথ নিয়ে দেশের হাল ধরে।

গত ২৪ দিনেও রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যুর পরও গণঅভ্যুত্থানে নিহত শত শত ছাত্র জনতার স্বজনদের কান্না যেন থামছেই না। আবু সাঈদের মা বারবার বিলাপ করে বলতে থাকেন,” গুলি করে আমার ছেলেটারে পাখির মত হত্যা করা হয়েছে”। আবু সাঈদের ছোট  বোন সুমি তখনও বলতে থাকে,” আমার ভাই ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, এইটে, ম্যাট্রিক সহ ইন্টারমিডিয়েট সরকারী কলেজ থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে। এতে আমার বাবা সেদিন খুশিতে কেঁদেছিল। অথচ আজ আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার  চাই”।

একই দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পঙ্গু হসপিটালে গণঅভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে গিয়ে  সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন,”গণঅভ্যুত্থানের শত শত ছাত্র জনতা প্রাণ হারিয়েছে। কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। এখনো আমি যে দৃশ্য দেখেছি তা দেখার মত নয়। ছোট ছোট ছেলেরা পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীর পাশাপাশি নিন্ম আয়ের কিশোরা পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত তালিকায় রয়েছে”। কথাগুলো বলতে বলতে মির্জা  ফখরুলের কন্ঠ কাঁপছিল। তার দুচোখে অশ্রু নেমে আসে। পাশে থাকা মির্জা আব্বাসও চশমা খুলে চোখ মুছলেন।

এদিকে গত মঙ্গলবার এর পর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের কান্না, শোক ও আত্মচিৎকার ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।গত বুধবার কর্মবিরতে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের আহ্বান নিয়ে আসা নতুন আইজিপির সামনে কাঁদতে কাঁদতে এক নারী সদস্য বলেন, “রাস্তায় রাস্তায় পুলিশকে খুঁজছে মারার জন্য। আমি পুলিশ। আমিও বাসা থেকে আসার সময় পুলিশের কার্ড আনতে সাহস পাইনি”।

৫ই অগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশের মধ্য অস্থিরতা ও অজানা আতংক বয়ে বেড়াচ্ছে।  ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি কারণে নজির বিহীন বল প্রয়োগের মাধ্যমে ছাত্র-জনতাকে দমনের নামে দেশে প্রায় পাঁচশতাধিক মানুষ নিহত হয়। নিহতের তালিকা এখন পর্যন্ত প্রায় ৪২জন পুলিশ সদস্য রয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক’শ পুলিশ। দেশের ৬৫২থানার মধ্যে ৪৫০টি থানা অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছড়িয়ে পড়া পুলিশ সদস্যরা আহাজারির মাধ্যমে বলেন,” আমাদের অগণিত সহকর্মী  মারা গেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের কাছে জানতে চাইছে তাদের বাবা কই? এখন আমরা তাদের কি জবাব দেব?এর জবাব কে দিবে? নিহত পরিবারের মধ্যে মাতম চলছে। সবাই এখন পুলিশ পিটাচ্ছে। পুলিশের মাঝে মৃত্যুর ভয় পেয়ে বসছে। তার উপর ঘৃণিত হয়ে পড়েছে পুলিশ। আমাদের সন্তানেরা এখন পুলিশ পরিচয়  দিতে লজ্জা পায়। সবাই এখন ছিঁ ছিঁ করছে। আমরা এখন ভয়ে চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। পুলিশের সন্মান যারা নষ্ট করেছে তাদের বিচার সহ বিভিন্ন দাবি জানানো  মধ্য দিয়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনুভূতি প্রকাশ করছে।

প্রায় সোয়া দুই লাখ পুলিশ সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অধীনে দেশের আইন-শৃঙ্খলা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এদিকে পুলিশের সাবেক আইজিপি মোঃ নুরুল হুদা সার্বিক অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমকে জানান, “সারা দেশে অগণিত পুলিশ হত্যার পর এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।তারা ক্ষুব্ধ। পুলিশের  সমস্যাগুলো দেখতে হবে পাশাপাশি জনগণের নিরাপত্তার সাথে পুলিশকে কাজে যোগ দিতে হবে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন “বৃহস্পতিবারের মধ্যে কোনো পুলিশ যোগ না দিলে ধরা হবে তাঁরা চাকরিতে ইচ্ছুক নন” বলে মন্তব্য করেছেন।

পুলিশের দুইশ বছরের ইতিহাসে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এত মৃত্যুর ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। লক্ষ লক্ষ সদস্যের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সারাক্ষণ তাদের শুধু বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

এদিকে বহুল আলোচিত আয়না ঘরের বন্দি শালা থেকে দীর্ঘ আট বছর পর মুক্তি পেয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী একটি গামছা দেখিয়ে বলেন,”গরমের সময় খালি গায়ে গামছা জড়িয়ে নামাজ পড়ার জন্য গামছাটি নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে এই গামছায় চোখের পানি মুছেছি।গত ৮ বছরে যে পরিমাণ চোখের পানি মুছেছি তা যদি সংরক্ষণ করা যেত তাহলে  চোখের জলে একটি  দিঘী পূর্ণ হয়ে যেত।  গত ৬ আগস্ট সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার সাথে ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমানও  আট বছর  বিনাবিচারে বন্দি ছিলেন।পরদিন ইউনাইটেড পিপল্‌স ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের নেতা মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর’ থেকে  পাঁচ বছর পর মুক্তি পেয়েছেন।

ভারতীয় গণমাধ্যম এই আয়না ঘরকে নাৎসি জমানায় জার্মানিতে বিরোধী পক্ষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক রাখার সাথে তুলনা করেছে। তারা ঢাকাতে ২৩টি বন্দিশালার মধ্যে আয়না ঘরকে একটি বলে উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬শ ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজদের প্রায় সবাই বিরোধী দল কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বী ছিল বলে মানবাধিকা সংস্থাগুলো এক সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে। গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের কান্নায় জল শুধু বয়েই চলছে বলে তাদের নিয়ে কাজ করা “মায়ের ডাক” নামক সংগঠনটি জানায়।

৫ই আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর হামলা, মন্দির ভাঙচুর্য ও বাড়ীঘরে আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়া নারী-পুরুষকে ফিলাপ করতে দেখা গেছে। সব হারিয়ে নি:শ্ব মানুষের কান্না এখন বয়েই চলেছে। ক্ষমতার পালা বদল ও বিভিন্ন ঘটনায় কেন বারবার সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করা হচ্ছে? তারাও তো এই দেশের মানুষ। এই নির্মমতা কি কোনদিন শেষ হবে না?##

আরও পড়ুন
- Advertisment -spot_img

সর্বশেষ