গণঅভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট গত পনের বছর ধরে চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে। সেদিন সারা দেশে কোটি কোটি ছাত্র জনতা রাস্তা বেরিয়ে আনন্দ উদযাপনের ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল বিশ্বে নজিরবিহীন। এই ঘটনা গ্রিনেস বুকে স্থান করে নিতে পারে বলে অনেকেই মনে করছে।
ছাত্রদের সাধারন একটা নিরীহ আন্দোলনের ৩৬তম দিনে মহাপ্রলয়ের রূপ ধারণ করে সৃষ্ট গনঅভ্যুত্থানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে। সেদিন দুপুরে তীব্র জনরোষে সরকারের পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়। এরপর দেশের প্রায় কয়েক কোটি ছাত্র-জনতা, নারী-পুরুষ, শিশু সহ আবাল বৃদ্ধ বনিতা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এই দিনটি ইতিমধ্যে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসের মযর্দা পেয়েছে।
সামান্য সংখ্যক পলায়নরত আওয়ামী দুষ্কৃতী ছাড়া সেদিন দেশের আপামর জনসাধারণ বাইরে বেরিয়ে আসে। দলমন নির্বিশেষে জাতীয় পতাকা হাতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও বড় দলে বিভক্ত হয়ে অলিগলিসহ রাজপথে সবাইকে আনন্দ মিছিল করতে দেখা গেছে। অনেকেই নিজ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন,ছেলে-মেয়ে ও নাতি নাতনিদের সাথে নিয়ে ঈদ মোবারক ধ্বনি দিয়ে বিজয় উদযাপন করেছে।
অনেকে নিজ নিজ এলাকার মোড়কে কেন্দ্র করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। উপজেলা, জেলা সদর কিংবা নগরীর বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী আন্দোলনের তীর্থস্থানকে কেন্দ্র করে অনেকেই সমবেত হয়েছে। আবার কেউ কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে বিজয়ী জনগণের দেশপ্রেমের আবেগ প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে সব আয়োজনে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা বহন করতে দেখা গেছে।
রাজনীতিতে সম্পৃক্তহীন লক্ষ লক্ষ জনতাকে এ সময় হাফ ছেড়ে কথা বলতে দেখা যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনেকেই শুকরিয়া পালন করে। স্বাধীনতা, মুক্তির স্বাদ এবং ইতিহাসের সাক্ষী হতে সবাই বিবেকের তাড়নায় রাজপথে নেমে আসে। প্রত্যন্ত গ্রাম, উপজেলা, শহর সহ রাজধানীর এমন কোন অলিগলি ছিল না যেখানে মানুষের স্রোত দেখা যায়নি। সেদিন দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজপথে নেমেছিল মানুষের ঢল। এত মানুষের ঢল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আর কখনো দেখা যায়নি। একাত্তরের স্বাধীনতার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমেছিল এবার ২০২৪ এর দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদযাপনে নেমেছিল কোটি কোটি মানুষ।
তবে দ্বিতীয় এই স্বাধীনতার জন্য ছাত্র-জনতাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। গত ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় সাত’শ ছাত্র জনতাকে হত্যা করার পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষকে আহত করা হয়।
এছাড়া গত ১৫ বছরের জনগনকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, ভয়াবহ দুর্নীতি, লক্ষ কোটি টাকা প্রচার সহ বিদেশে বেগম পাড়ার সৃষ্টি, দ্রব্যমূলের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি,পন্যের বাজারে সিন্ডিকেট বাণিজ্য, বিডিআরের ৫৭ জন অফিসার হত্যা করা, হত্যা-গুম ও আয়না ঘরের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে মাফিয়া স্টেট তৈরি করা, ৫ই মে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাযজ্ঞ, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে পুরো দেশকে একটি ভয়ের উপত্যকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
গত ১৫ বছরের জনরোষের উত্তপ্ত কড়াইয়ের উপর ৩৬ দিনে শিক্ষার্থীদের বিদ্রোহে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রানভয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
অথচ ছত্রিশ দিন আগেও কেউ কল্পনা করেনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারকে এভাবে পরাজিত করা যাবে? ছাত্রদের নিরিহ একটা আন্দোলন তখন সবেমাত্র দানা বাঁধতে শুরু করে।
২০২৪ সালের ৫ই জুন হাইকোর্টে ২০১৮ সালের সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণার কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পহেলা জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন সূচিত হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে “বাংলা ব্লকেটে”র মাধ্যমে বিক্ষোভের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের “রাজাকার” আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তীব্র আপত্তিকর উক্তিতে শিক্ষার্থীরা খেপে উঠে। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে মেয়েদের আবাসিক হল থেকে শত শত মেয়েরা হল থেকে বেরিয়ে এসে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এই সময় নেমে আসে সরকারী পেটোয়া বাহিনীর নিমর্মতা। মারমুখি পুলিশ ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর সহ বহিরাগত সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সহ আবাসিক হল, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা সারাদেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হতে থাকলেও রাজপথের দখল ছাত্রদের কব্জায় থাকে । এতে সরকার ভীত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ সহ আবাসিক খালি এবং সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধদের নির্দেশ দেয়।
১৬ই জুলাই রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় ঢাকার মেরুল বাড্ডা, প্রগতি সরণী, কুড়িল ও মিরপুর এলাকার বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসলে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ ধারণ করে।শুরু হয় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাথে মুহ মুহ সংঘর্ষ। এদিন চট্টগ্রামের মুরাদপুরে তিন জন সহ ঢাকা ও সারাদেশে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হয়। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেও আন্দোলনের তীব্রতা কমাতে পারেনি।
১৭ জুলাই রাতে আন্দোলনকারীরা পরদিন ১৮ জুলাই থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণার পর মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশ অচল হয়ে পড়লে পুলিশ, বিডিআর ও সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে অকাতরে আত্মহতি দেয় শত শত ছাত্র জনতা। গণহত্যার পাশাপাশি চলে ব্লক রেইড, গণ গ্রেপ্তার, গুম, খুন, সহ পরিকল্পিত নাশকতা। হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ সহ সংঘর্ষের ঘটনার শতাধিক নিহত ও হাজার হাজার ছাত্র জনতা আহত হলেও তারা রাজপথ ছাড়িনি। ১৯ শে জুলাই মাদ্রাসার ছাত্ররাও আন্দোলনে যোগ দেয়।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণহত্যার বিচার ও শিক্ষার্থীরাদের ৯ দফা দাবিতে স্বেচ্ছার হয় দেশের শিক্ষক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ নাগরিক সমাজ। পাশাপাশি জনরোষ ছড়িয়ে পরে দেশের প্রতিটি কোনে।
৩১ শে জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণার পর দিন ১লা আগস্ট ছয় ছাত্র সমন্বয়কে ডিবি’র হেফাজত থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়।
২ আগস্ট ছাত্র-জনতা সহ নাগরিক সমাজের ঢাকা দ্রোহযাত্রায় হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে নয় দফার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।
৩ আগস্ট হাসিনা সরকারের “গণভবনের দরজা খোলা” বলে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লক্ষ লক্ষ ছাত্রজনতার সামনে সমন্বায়ক নাহিদুল ইসলাম হাসিনা সরকারের পদত্যাগের জন্য এক দফার ঘোষণা দেন। এতে ছাত্র-জনতা, অভিবাবক সহ সাধারণ নারী-পুরুষ ও শিশুরা রাজপথে নেমে এসে। জনগণের সাথে থাকার সেনাপ্রধানের প্রচ্ছন্ন ঘোষণায় আন্দোলন আরো তুঙ্গে উঠে।
৪ আগস্ট সরকারের পতন আসন্ন জেনে আওয়ামী লীগ সহ ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা পুলিশের ছাত্রছায়ায় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শেষ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে সবাই পালিয়ে যায়। কারফিউর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন “লং মার্চ টু ঢাকা” ঘোষণা একদিন এগিয়ে পাঁচ আগস্ট নির্ধারণ করলে সারাদেশে তীব্র উত্তেজনার সষ্টি হয়। এদিন বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনার ১৪ পুলিশ সহ শতাধিক ছাত্র জনতা নিহত হয়।
৫ ই আগস্ট সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুলিশ গুলি বর্ষণের মাধ্যমে গণজাগরণ ঠেকানোর শেষ চেষ্টা চালায়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলির মধ্য কারফিউ উপেক্ষা করা লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে গণভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বেলা আড়াইটার সময় হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। এর সাথে অবসান হয় গত পনের বছর ধরে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে থাকা স্বৈরতন্ত্রের। মুক্তি পায় প্রায় ১৮ কোটি মানুষ।###